সুচিপত্র
কালো জামের মতোই দেখতে আজওয়া খেজুর মানবদেহের জন্য খুবই উপকারি। কুরআন ও হাদিসে একাধিকবার এই খেজুরের কথা বর্ণিত হয়েছে। রোজার সময় খেজুর খাওয়ার প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যায় আমাদের দেশে। কিন্তু এই ফলটি খাওয়া উচিত নিয়মিত। কেন খাওয়া উচিত? এখানে জেনে নিন আজওয়া খেজুরের ১৬ টি উপকারিতা সম্পর্কে।
আজওয়া খেজুর ও এর পুষ্টি উপাদান
বিশ্বের মধ্যে বেশিরভাগ খেজুর উৎপাদিত হয়ে থাকে আরবে। আজওয়া খেজুর সবচেয়ে বেশি। তন্মধ্যে সৌদি আরবের মদীনা অঞ্চলে এই খেজুরের উৎপাদন হয় বেশি। যত রকমের খেজুর রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে আজওয়া খেজুর সবচেয়ে উত্তম ও ফজিলতপূর্ণ। কারণ, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নিজে এই খেজুরের বিভিন্ন গুণাগুণের কথা বলে গিয়েছেন। মহানবী (সাঃ)-এর প্রিয় খাবার ছিল এটি। রমজান মাসে ইফতারে খেজুর খাওয়া সুন্নাত।
এই খেজুর দেখতে ছোট ও মাঝারি আকৃতির হয়ে থাকে। কিন্তু অন্যান্য খেজুরের চেয়ে এর রঙ আলাদা। জামের মতো কালো রঙের হয়ে থাকে এই খেজুর। দামের দিক থেকেও অন্যান্য খেজুরের তুলনায় এর দাম বেশি।
এই খেজুরে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান যা প্রতিটি মানুষের সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয়। খেজুর শুকনো প্রকৃতির ফল বিধায় এতে কার্বোহাইড্রেট-এর পরিমাণ বেশি থাকে।
এছাড়াও আজওয়া খেজুরে রয়েছে – ন্যাচারাল সুগার, ভিটামিন-এ, ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-ই, ভিটামিন-কে, ফ্যাটি এসিড, ফাইবার ( আঁশ), পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, সোডিয়াম, বিটা ক্যারোটিন, আয়রন, কপার, উন্নতমানের ক্যালরি ও এন্টিঅক্সিডেন্ট।
এই পুষ্টি উপাদানসমূহ প্রত্যেক মানুষ জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোর অভাবে দেহে জটিল রোগের তৈরি হতে পারে। তাই শুধু রোজার মাসেই নয়, নিয়মিত আজওয়া খেজুর খাওয়ার চেষ্টা করা সবারই উচিত।
আজওয়া খেজুর এর ফজিলত
হাদিসে এসেছে, কোনো ব্যক্তি যদি সকালে খালি পেটে ৭ টি আজওয়া খেজুর খায়, তাহলে সারাদিন সে বিষক্রিয়া ও জাদুর কবল থেকে মুক্ত থাকবে।
হযরত সা’দ (রাঃ) নামক একজন সাহাবী বাস্তব প্রমাণ দিয়েছেন যে, তিনি যখন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তখন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁকে রোগমুক্তির জন্য টানা ৭ দিন আজওয়া খেজুর খেতে বলেছিলেন।
কুরআনে খেজুরের উপকারিতা বিষয়ে একাধিকবার বলা হয়েছে। খেজুরের উপকারিতা বৈজ্ঞানিকভাবেও প্রমাণিত হয়েছে। জটিল ও বড় বড় অনেক রোগ থেকে মুক্তি পেতে খেজুর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বিভিন্ন এন্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর এই খেজুর হৃদরোগ, ত্বকের সমস্যা, যৌন সমস্যা সহ বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে কার্যকর।
এখন জেনে নিন আজওয়া খেজুরের ১০ টি উপকারিতা সম্পর্কে।
আজওয়া খেজুর এর ১০ টি উপকারিতা
১. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি
এমিনো এসিড, ফেনোলিক এসিড, ফ্লেভোনয়েডস, ক্যারোটিনয়েডস – এই ৪ টি উপকারী এন্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে এই খেজুরের মধ্যে। মানবদেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এন্টিঅক্সিডেন্ট খুবই কার্যকর। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো থাকলে সহজেই অন্যান্য রোগ থেকে মুক্ত থাকা যায়।
২. হার্ট ভালো রাখে
রক্তের ক্ষতিকর কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে কাজ করে আজওয়া খেজুর। হৃদরোগের জন্য অস্বাভাবিক রক্তচাপ একটি কারণ। রক্তচাপের সমস্যা দূর করার মাধ্যমে হৃদপিণ্ডকে স্বাভাবিকভাবে রক্ত সরবরাহ করতে সাহায্য করে এই ফল। ফলে বিভিন্ন হৃদরোগ থেকে দূরে থাকা সম্ভব হয়।
৩. কিডনি সুস্থ রাখে
একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, আজওয়া খেজুরে এমনকিছু উপাদান রয়েছে যা কিডনিকে বিভিন্ন ক্ষতির হাত থেকে সুরক্ষা দিয়ে থাকে। কিডনিতে পাথর, মূত্রথলির সংক্রমণ, কিডনি বিকল ইত্যাদি সমস্যা থেকে কিডনিকে রক্ষা করে।
৪. হজমশক্তি বৃদ্ধি করে
মানুষের পেটের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে ফাইবার অতি প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান। ফাইবারযুক্ত খাবার পরিপাকতন্ত্র ভালো রাখে। পরিপাকতন্ত্র ভালো থাকলে খাবার হজমে কোনো সমস্যা থাকে না। প্রতিদিন অন্তত ৫ টি আজওয়া খেজুর খেলে বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো পেটের বিভিন্ন সমস্যা দূর করা সহজ হয়।
৫. মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ায়
ফ্লেভোনয়েডস এন্টিঅক্সিডেন্ট মস্তিষ্কের বিভিন্ন প্রদাহ, স্নায়ুকোষের দূর্বলতা দূর করতে অধিক কার্যকর। এতে আরও আছে পটাশিয়াম যা স্নায়ুবিক সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সহায়ক। আলঝেইমার্স, ডিমেনশিয়ার মতো মারাত্মক স্নায়ুরোগগুলোর প্রতিরোধ করতে আজওয়া খেজুরে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ এসব উপাদান। স্নায়ুর বৈকল্য দূর করে স্মৃতিশক্তির উন্নতিতেও সহায়তা করে।
৬. দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে সহায়ক
এতে রয়েছে ভিটামিন-এ ও বিটা ক্যারোটিন, যা চোখের বিভিন্ন সমস্যা যেমন- চোখে ঝাপসা দেখা ও রাতকানার মতো রোগ প্রতিকারে সহায়তা করে।
৭. ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করে
ডায়াবেটিস রোগীরা মিষ্টি খেতে ভয় পেলেও খেজুরের মতো মিষ্টি ফল খেলে ভয়ের কারণ নেই। রক্তের গ্লুকোজ ও চর্বির মাত্রা হ্রাস করতে আজওয়া খেজুর উত্তম ভূমিকা পালন করে। সেই সাথে ইনসুলিনের মাত্রা বাড়ায়। যা ডায়াবেটিসের মতো মরণঘাতী রোগের প্রতিরোধে সাহায্য করে। যাদের ডায়াবেটিস আছে, তারা নিশ্চিন্তে প্রতিদিন ২-৭ টি খেজুর খেতে পারেন, কারণ এই প্রজাতির খেজুর ন্যাচারাল সুগার সমৃদ্ধ।
৮. ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে পারে
অনেকদিন ধরে চলা এক গবেষণায় উঠে এসেছে, বিটা ডি-গ্লুকেন নামক একটি উপাদান এতে রয়েছে যা টিউমার ও ক্যান্সার সৃষ্টিকারী কোষগুলোর বিরুদ্ধে কাজ করে। প্রতিদিন এই উত্তম খেজুর খাওয়ায় টিউমার ও ক্যান্সারের জন্য দায়ী ক্ষতিকারক কোষ ধ্বংস করা যায়।
৯. পুরুষের যৌন ক্ষমতার বৃদ্ধি করে
ফ্লেভোনয়েডস এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ এন্টিঅক্সিডেন্ট যা পুরুষদের বীর্যে শুক্রাণুর সংখ্যা বৃদ্ধি করে। রক্ত সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার মাধ্যমে যৌন ক্ষমতা বাড়াতেও সহায়তা করে।
১০. নারীদের গর্ভধারণ সহজ করে
গর্ভবতী নারী তার গর্ভকালীন সময়ের শেষ মাসে যদি ঘনঘন আজওয়া খেজুর খেয়ে থাকে, তাহলে তার স্বাভাবিকভাবে সন্তান জন্মদান ( নর্মাল ডেলিভারি) করতে সুবিধা হয়। এবং গর্ভকালীন সময়ে পেট ও পায়ুপথের বিভিন্ন সমস্যা যেমন- কোষ্ঠকাঠিন্য, পাইলস্ প্রতিকারেও সাহায্য করে।
১১. তারুণ্য ধরে রাখে
অনেককেই দেখা যায় বয়স বেশি না হলেও চেহারার মধ্যে বেশি বয়সের ছাপ। ত্বকের সতেজতা কমে যায়, চেহারায় মলিন অবস্থা বিরাজ করে। আজওয়া খেজুরে থাকা একাধিক এন্টিঅক্সিডেন্ট এই সমস্যা থেকে দ্রুতই মুক্তি দেয়। আজওয়া খেজুরের মধ্যে আছে ভিটামিন-সি ও এন্টিঅক্সিডেন্ট, যা ত্বকের কুঁচকে যাওয়া, চামড়ায় ভাঁজ পড়া ইত্যাদি সমস্যা থেকে পরিত্রাণ দেয় এবং ত্বকে সতেজতা, তারুণ্য ধরে রাখে।
১২. রক্তের বিষক্রিয়া দূর করে
লিভারের কাজ স্বাভাবিক রাখতে খেজুর কার্যকর ভূমিকা রাখে। লিভারের কাজ স্বাভাবিকভাবেই হওয়ায় রক্ত থেকে বিভিন্ন বিষাক্ত ও দেহের জন্য ক্ষতিকর পদার্থ ছাঁকন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেহ থেকে বের হয়ে যায়।
১৩. রক্তাল্পতা প্রতিরোধ করে
এই ফলে রয়েছে আয়রন, কপার ও আরও কয়েকটি খনিজ উপাদান, যেগুলো দেহে রক্ত উৎপাদনের কাজ করে। রক্তস্বল্পতা দূর করতে নিয়মিত খেজুর খেলে এই জটিল রোগ প্রতিকার করা যায়।
১৪. চুল পড়া বন্ধ করে
আয়রন দেহে রক্ত উৎপাদনে কাজ করে। মাথার ত্বকে চলাচল স্বাভাবিক থাকলে তালু সবল থাকে। ফলে চুলের গোড়া শক্তিশালী হয় ও চুল পড়ার হার কমে।
১৫. দাঁত ও হাড়ের গঠন মজবুত করে
এতে বিদ্যমান ক্যালসিয়াম দাঁতের ও হাড়ের জন্য খুব প্রয়োজনীয় উপাদান। কারণ, ক্যালসিয়াম দাঁত ও হাড়ের গঠন সবল ও মজবুত করতে কার্যকর।
১৬. প্রদাহ প্রতিরোধী গুণসম্পন্ন
ফ্লেভোনয়েডস ও ফেনোলিক এসিড দেহের বিভিন্ন ব্যথা, ফোলা, ক্ষত সারাতে অত্যন্ত কার্যকরী।
আজওয়া খেজুর অনেক বরকতময় একটি খাবার। রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সকালের নাশতায় খেজুর খেতেন। সাহাবীদেরকে খেজুর চাষে উৎসাহ দিতেন।
সুতরাং, শুধু একটা নির্দিষ্ট সময় অথবা নির্দিষ্ট কোনো মাসেই খেজুর না খেয়ে নিয়মিত খেজুর খাওয়া ভালো। প্রতিদিন আজওয়া খেজুর খাওয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন জটিল শারীরিক সমস্যা থেকে দূরে থাকা সম্ভব। বড়দের পাশাপাশি ছোটদেরকেও এই খেজুর খাওয়ালে শিশুকাল থেকেই অনেক স্বাস্থ্য উপকার পাওয়া যাবে।
আরো পড়ুন >> সূরা ইয়াসিন এর ফজিলত
মাশাআল্লাহ অনেক উপকৃত হলাম