উসমানীয় সাম্রাজ্য যেভাবে প্রতিষ্ঠা পায় উত্থান ও পতন

অটোমান সাম্রাজ্য যা আরবিতে ” উসমানীয় সাম্রাজ্য “, এক সুবিশাল শাসনামল। যা চতুর্দশ ও বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এশিয়ার পশ্চিমাঞ্চল, দক্ষিণপূর্ব ইউরোপ ও আফ্রিকার উত্তর অঞ্চল শাসন করতো। ১২৯৯ সালে সূচনা হয়ে ১৯২২ সালে তুরস্কের যুদ্ধের পর অবসান ঘটে দীর্ঘকালীন এই সাম্রাজ্যের। উসমানীয় সাম্রাজ্য কীভাবে উণ্থান হয়েছিল, কীভাবে পতন ঘটেছিল, কেমন ছিল সেই সাম্রাজ্যের শাসন – এসব বিস্তারিত আপনাদের কাছে তোলে ধরা হবে এই লেখার মাধ্যমে। 

উসমানীয় সাম্রাজ্য যেভাবে প্রতিষ্ঠা পায়

ইসলামের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে উসমানীয় সাম্রাজ্য। এই সাম্রাজ্যের মাধ্যমে মুসলমান সম্প্রদায়ের শাসকদের নানা কীর্তি, ইতিহাস গড়ে উঠেছিল। 

১২৯৯ সালে আরতুগ্রুল গাজীর মাধ্যমে এই সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা পায়। অঘুজ বংশ ছিল তুরস্কের বসবাসকারী এক সম্প্রদায়। সেলজুক সাম্রাজ্য ছিল তৎকালীন রোমের ক্ষমতাশালী সম্প্রদায়। সেই সেলজুক সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল তুরস্ক। বাইজেন্টাইন শাসকদের বিরুদ্ধে আরতুগ্রুল গাজীর বীরত্বের প্রমাণ পেয়ে সেলজুক রাজা আরতুগ্রুল গাজীকে পশ্চিম আনাতোলিয়া শাসনের দায়িত্ব দেয়।

শুধু শাসনের দায়িত্ব দিয়েই সেলজুক রাজা থামেনি। রাজা তার মেয়ে হালিমা সুলতান-কে আরতুগ্রুল গাজীর সাথে বিয়ে দেয়। ফলে আরতুগ্রুল গাজী হয়ে যায় সেলজুক রাজবংশের জামাই।

সেলজুক শাসনামলের শেষের দিকে অঘুজ বংশীয় আরতুগ্রুল গাজী আর অধীনে থাকতে চাইলেন না। নিজেদের স্বাধীনতা দাবি করলে তারা আলাদা সাম্রাজ্য হিসেবে প্রকাশ পায়। এরপর আরতুগ্রুল গাজী নিজ বংশ ও অঞ্চল নিয়ে বড় একটি শাসনামল গড়ে তোলেন। 

আরতুগ্রুল গাজীর প্রথম সন্তান ছিলেন উসমান গাজী, যাকে প্রথম উসমান বলা হয়। প্রথম উসমানের শাসনামলের মাধ্যমে উসমানীয় সাম্রাজ্য শুরু হয় বিধায় এই সাম্রাজ্যের নামকরণ করা হয় ” উসমানীয় সাম্রাজ্য”।

উসমানীয় সুলতানগণ পরবর্তীতে বিভিন্ন যুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে এই সাম্রাজ্যের আয়তন আরও বৃদ্ধি করেন।

এভাবেই শুরু হয় উসমানীয় সুলতানদের সাম্রাজ্য।

তুরস্কে এই সাম্রাজ্য “উসমানলি দেভলেতি” নামে পরিচিত। যেহেতু আরতুগ্রুল গাজীর মাধ্যমে এই সাম্রাজ্য যাত্রা শুরু করে, তাই প্রথম উসমানের সাথে তার পিতা আরতুগ্রুল গাজীর নাম একসাথে করে এই সাম্রাজ্যের নামকরণ ” উসমানলি ইম্পারাতুরলুগু” করে তুর্কি ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ।

উসমানীয় সাম্রাজ্য
উসমানীয় সাম্রাজ্য

উসমানীয় সাম্রাজ্যের বিস্তার 

শুরুতে তুরস্কে হলেও পরবর্তীতে এই সাম্রাজ্য আরও বিস্তৃতি পায়। ক্রমেক্রমে এই সাম্রাজ্যের শাসকেরা এশিয়ার পশ্চিমাঞ্চলের পুরাটা, ইউরোপ ও আফ্রিকায় নিজেদের ক্ষমতা বিস্তার করে। 

তাদের সাম্রাজ্যের বিস্তারের উল্লেখযোগ্য উদাহরণগুলো হলো – প্রথম উসমানের পুত্র প্রথম উরহান ১৩২৪ সালে “বুরসা” অঞ্চল জয় করে এর কর্তৃত্ব নেয়, ১৩৮৭ সালে “সেলোনিকা”, ১৩৮৯ সালে “কসোভো” জয়ের মাধ্যমে সার্বিয়ার কর্তৃত্ব লাভ করে উসমানীয় শাসক। এই অঞ্চল গুলো জয় করে ইউরোপে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় উসমানীয় সাম্রাজ্য।

উসমানীয় সুলতান প্রথম বায়েজিদের আমলে ১৪০২ সালে তৈমুর লং-এর কাছে উসমানীয় বাহিনী “আঙ্কারার যুদ্ধে ” হেরে যায়। তৈমুর লং উসমানীয় সুলতান প্রথম বায়েজিদকে বন্দী করে। এতে সাম্রাজ্যে অস্থিরতা তৈরি হয়। তখন উসমানীয় সুলতান কে হবে তা নিয়ে ১৪০২ থেকে ১৪১৩ সাল পর্যন্ত গৃহযুদ্ধ চলে। অনেক যুদ্ধ, আলোচনা সমালোচনার পর উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান হন প্রথম মুহাম্মাদ। প্রথম মুহাম্মাদের ক্ষমতা লাভের মাধ্যমে উসমানীয় সাম্রাজ্য পুনরায় সচল হয়ে উঠে।

১৪০২ সালে তৈমুর লং-এর কাছে পরাজিত হলে সেলোনিকা, কসোভো,  মেসিডোনিয়া সহ আরও কিছু অঞ্চলের কর্তৃত্ব হারায় উসমানীয়রা। কিন্তু সুলতান দ্বিতীয় মুরাদের শাসনামলে (১৪৩০-১৪৫০ সাল) সেসব অঞ্চল আবারও উসমানীয়দের অধীনে চলে আসে।

১৪৫৩ সালে দ্বিতীয় মুরাদের পুত্র দ্বিতীয় মুহাম্মদ কনস্টান্টিনোপলের কর্তৃত্ব লাভ করে এই সাম্রাজ্যের আরও প্রসার ঘটান। 

ইতিহাস ঘাটলে জানা যায়, উসমানীয় সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ বিস্তার সাধিত হয়েছে পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে। কারণ, এই সময়কালে অনেক দক্ষ ও সুবিবেচক শাসকেরা এই সাম্রাজ্য পরিচালনা করেছিল। এই সময়ে সীমানা বিস্তারের সাথে সাথে অর্থনৈতিক সীমানাও উন্নত হতে থাকে। পারস্য, মিশর দখল, লোহিত সাগরে কর্তৃত্ব, নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনীর কার্যক্রম প্রতিষ্ঠা পায়। এই কাজগুলো হয়েছিল উসমানীয় সুলতান প্রথম সেলিমের আমলে।

সুলতান দ্বিতীয় সুলাইমানের আমলে ইউরোপের অধিকাংশ অঞ্চল উসমানীয়দের অধীনে আসে। শুধু পশ্চিম ইউরোপ ও পশ্চিম হাঙ্গেরীয় অঞ্চল উসমানীয়দের কর্তৃত্বের বাইরে থাকে।

একাধিকবার ভিয়েনা আক্রমণ করে ব্যর্থ হলেও মলডোভিয়া, ট্রান্সিলভানিয়া, ওয়ালচিয়া ও বাগদাদ উসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনে চলে আসে।

হাবসবার্গ শাসনের পরাজয় 

হাবসবার্গ শাসনের বিরুদ্ধে জয় পেতে ফ্রান্সের সাথে উসমানীয় শাসকদের মিত্রতা গড়ে উঠে। ফ্রান্সের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে উসমনায়ীরা “নাইস” ও “করসিকা” অঞ্চলের শাসন করায়ত্ত করতে সফল হয়। উসমানীয়দের ক্ষমতা অনুধাবন করতে পেরে ১৫৪৭ সালে হাবসবার্গ অধিপতি ফার্ডিন্যান্ড উসমানীয়দের কাছে নতি স্বীকার করে এবং ক্ষমতা ত্যাগ করে।

উসমানীয় সাম্রাজ্য যেভাবে বিলুপ্তির দিকে যায়

যে সাম্রাজ্যকে রোমান সাম্রাজ্যের সাথে তুলনা করা হতো, সেই শক্তিশালী সাম্রাজ্য ষোড়শ শতকের শেষের দিকে অনগ্রসর হয়ে পড়তে শুরু করে। এর কারণ হিসেবে ধরা হয় রাজদরবারের মধ্যকার সমস্যাকে। যেমন- সুলতানের অধীনস্থ কর্মচারীদের অসৎ উপায় অবলম্বন, লোভ, দূর্নীতি, বিশ্বাসঘাতকতা, অদক্ষ বাহিনী ইত্যাদি। 

আরও যে সমস্যাটি প্রকট আকার ধারণ করেছিল তা হলো জনসংখ্যার বৃদ্ধি। অতিরিক্ত জনসংখ্যা যেকোনো অঞ্চলের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে বাঁধার সৃষ্টি করে। বাড়ন্ত জনসংখ্যার জন্য যথেষ্ট সীমানা না থাকা সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে সমস্যা বাড়িয়ে তুলে।

হাবসবার্গ উসমানীয়দের মিত্র হিসেবে থাকলেও হাবসবার্গের শাসকেরা একসময় বিশ্বাসঘাতকা করে। উসমানীয়রা ভিয়েনা দখল করতে গেলে হাবসবার্গ শাসকেরা জার্মানি ও পোল্যান্ডের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে উসমানীয়দের ভিয়েনা থেকে বিতাড়িত করে। মিত্রদের এমন বিশ্বাসঘাতকতা সাম্রাজ্যের ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করে।

উসমানীয় সাম্রাজ্যের এসব সমস্যার সময়কালে ইউরোপীয়রা নিজেদেরকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে শুরু করে। সঠিকভাবে সাম্রাজ্য পরিচালিত না হওয়ায় সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটতে শুরু করে।

ইউরোপীয়রা এই সময় সামরিক শক্তি বৃদ্ধি, নতুন বাণিজ্য সীমানা সৃষ্টি করে নিজেদেরকে উসমানীয়দের অধীনের বাইরে নিয়ে যেতে শুরু করে। ফলে ইউরোপে উসমানীয় সাম্রাজ্য অকার্যকর হওয়ার পর্যায়ে চলে যায়। লেপান্টোর যুদ্ধে উসমানীয়দের পরাজয়, ভেনিসের সাথে পেরে না উঠা সাম্রাজ্যকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। এমতাবস্থায় এক শান্তিচুক্তির মাধ্যমে উসমানীয়রা ইউরোপের সর্বত্র শাসনের আশা ছেড়ে দিয়ে আফ্রিকার দিকে মনোযোগী হয়।

ক্ষমতার এই অনগ্রসরতার মাঝেও উসমানীরা থেমে থাকেনি। শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তিগত বিভিন্ন উন্নয়ন সাধনে তারা কাজ করেছে। ইস্তানবুল টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, আর্টিলারি স্কুল, ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা, সামরিক শক্তি বৃদ্ধি, ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু সহ শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে উসমানীয়রা উন্নয়ন ঘটাতে থাকে।

উসমানীয় সাম্রাজ্য
উসমানীয় সাম্রাজ্য

উসমানীয় সাম্রাজ্য অবসান

ক্ষমতা ও সাম্রাজ্যের আয়তন কমতে থাকা, রাশিয়ার সঙ্গে পেরে না ওঠা, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, ইউরোপীয়দের কর্তৃত্ব বিস্তার লাভ – এই কারণগুলোকে উসমানীয় সাম্রাজ্য অবসানের কারণ হিসেবে বলা হয়।

রাশিয়ানরা উসমানীয়দের সাথে যুদ্ধে জড়ালেও আমেরিকা তা করেনি। আরব বিদ্রোহ উসমানীয় শাসনে আরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আরব বিদ্রোহের সময়ে মুসলিমরা তুরস্কের বিভিন্ন অঞ্চল ছেড়ে চলে যেতে থাকলে উসমানীয়রা ক্ষমতা আরও হারাতে থাকে।

১৯২২ সালে তুরস্ক স্বাধীনতা আন্দোলন করে বিজয় লাভ করলে সালতানাত প্রথা বাতিল করা হয়। সুলতানি শাসন বাতিলের মাধ্যমে উসমানীয় সাম্রাজ্যও বাতিল ঘোষণা করা হয়। এই আইনের সময় উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান ছিলেন ষষ্ঠ মুহাম্মাদ। তুর্কীরা স্বাধীনতা অর্জনের পর একই বছরের নভেম্বরের ১ তারিখে সুলতানি শাসনামল বিলুপ্ত করা হয়। শাসন ক্ষমতা হারিয়ে উসমানীয় সাম্রাজ্যের সর্বশেষ সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মাদ দেশ থেকে চলে যান।

এভাবেই বিলুপ্ত ঘটে ৬০০ বছরেরও অধিক সময় ধরে চলা শাসনামলের।

১২৯৯ সাল থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত মোট ৩৬ জন সুলতান উসমানীয় সাম্রাজ্য পরিচালনা করেছে। প্রথম উসমান থেকে শুরু করে সর্বশেষ সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মাদ পর্যন্ত দীর্ঘ ৬০০ বছরের অধিক সময় শাসনামল স্থায়ী হয় উজ্জ্বল এই সাম্রাজ্যের। মুসলমানদের ক্ষমতার ইতিহাসে উসমানীয় সাম্রাজ্য ছিল এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

আরো পড়ুন >>    বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য রচনা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *