কালোজিরার উপকারিতা

ছোট দানাজাতীয় শস্য কালোজিরা। এর মধ্যে কত উপকারী গুণ রয়েছে তা অনেকেই জানেন না। কালোজিরা -কে বলা হয় সকল রোগের এক মহৌষধ। হাদিসে বলা আছে, মৃত্যু ব্যতীত সকল রোগের মহৌষধ হলো কালোজিরা। কালোজিরার উপকারিতা সম্পর্কে না জানার কারণে অতি গুরুত্বপূর্ণ এই শস্য জাতীয় খাদ্যের গুণাগুণ থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি।

এই আর্টিকেলের মাধ্যমে জেনে নিন কালোজিরার উপকারিতা সম্পর্কে, কীভাবে কালোজিরা খেলে উপকার পাওয়া যাবে এবং এর ক্ষতিকর কোনো দিক আছে কি-না এসব বিষয়ে।

কালোজিরা ও এর গুণাগুণ 

কালোজিরা একপ্রকার বীজজাতীয় শস্য, যা ফলের ভিতরে হয়। কালোজিরা গাছের প্রতিটি ফলে ২০ টিরও বেশি কালো কালো দানা বা বীজ থাকে যেগুলো কালোজিরা নামে পরিচিত। বৈজ্ঞানিকভাবে এর নামকরণ করা হয়েছে Nigella Sativa Linn. কালোজিরা মূলত রান্নায় ও খাবারে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। 

শুধু খাবার হিসেবেই নয়, এর রয়েছে ১০০-এরও অধিক উপকারী গুণাগুণ, যা ছোট-বড় বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা নিরাময় করতে কার্যকর। আয়ুর্বেদিক বিভিন্ন ওষুধ তৈরিতে কালোজিরা অন্যতম মূল উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

কালোজিরায় রয়েছে – আমিষ, শর্করা, ভিটামিন, জিংক, কপার, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, আয়রন, নিয়াসিন, থায়ামিন, স্বাস্থ্যকর চর্বি, বিভিন্ন এন্টিঅক্সিডেন্ট।

ছোট শিশু, কিশোর-কিশোরী, বয়স্ক – যেকোনো বয়সী মানুষের জন্যই কালোজিরা ওষুধ হিসেবে কাজ করে। এবং উপযুক্ত ফলাফলও পাওয়া যায়।

কালোজিরার উপকারিতা গুলো

বহু গুণে গুণান্বিত এই ছোট শস্যদানা। ইসলাম ধর্মের নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ), কালোজিরাকে মৃত্যু ব্যতীত অন্যান্য সকল রোগের ওষুধ বলেছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানেও এই বীজটির কার্যকরী গুণাগুণ প্রমাণিত।

কালোজিরা যেসব উপকার করে থাকে তা নিম্নরূপ :

শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো

মধুর উপকারিতা সম্পর্কে আমরা জেনেছি। মধু মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেয়। কারণ মধুতে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান। কালোজিরাতেও রয়েছে তেমনই গুরুত্বপূর্ণ শ’খানেক পুষ্টি গুণ, যা কারও শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উন্নতি ঘটাতে সক্ষম। দেহে রোগ প্রতিরোধকারী ক্ষমতা বাড়লে কোনো রোগ সহজেই আক্রমণ করতে পারে না।

মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ানো

কালোজিরায় রয়েছে এন্টিবায়োটিক ও এন্টিঅক্সিডেন্টের বিভিন্ন উপাদান, যা মানব মস্তিষ্কের উন্নয়ন ঘটাতে খুবই দরকারি। মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে মস্তিষ্কের কোষগুলোকে আরও কার্যকর করে তোলে কালোজিরার ঔষধি উপাদানসমূহ। ফলে স্নায়ুবিক বিভিন্ন সমস্যা দূরে থাকে, স্মৃতিশক্তি বাড়ে।

রক্ত চলাচল ভালো রাখে

অস্বাভাবিক রক্তচাপের কারণে হৃদরোগ, ডায়াবেটিসের মতো মারাত্মক রোগ হতে পারে। রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক হওয়া তাই খুবই প্রয়োজনীয়। দেহের রক্ত সরবরাহ যাতে সুষ্ঠুভাবে হয়, তার সকল উপাদান কালোজিরায় উপস্থিত। তাই নিয়মিত কালোজিরা খাওয়ায় রক্ত চলাচল ভালো থাকে।

ক্যান্সারের প্রতিরোধ 

ব্লাড ক্যান্সার, মহিলাদের ব্রেস্ট ক্যান্সার, ব্রেইন ক্যান্সারের মতো ভয়ংকর রোগগুলোর জন্য দায়ী কোষগুলোকে ধ্বংস করতে কালোজিরার তেলে রয়েছে কার্যকর উপাদান। যা ক্যান্সারের কোষগুলোকে ধ্বংস করার মাধ্যমে দেহে প্রতিরোধ ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করে তোলে।

ডায়াবেটিসের চিকিৎসায়

চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা কালোজিরার তেলে এমন কিছু উপকারী উপাদান খুঁজে পেয়েছেন, যে উপাদানগুলো ডায়াবেটিসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। যা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীকে এই রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। ইনসুলিনের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে কালোজিরা কাজ করে।কালোজিরার উপকারিতা

 

 

 

ফুসফুসের সুস্থতায়

অ্যাজমা বা হাঁপানি রোগ সহ শ্বাসতন্ত্রের রোগে যারা ভোগে, তাদের জন্য কালোজিরা একটি ভালো ওষুধ। ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত অনেক রোগী কালোজিরা খেয়ে উপকার পেয়েছে বলে মতামত দিয়েছে।

লিভার বা যকৃত সুস্থ রাখে 

যকৃতের ক্যান্সারের জন্য দায়ী বিষাক্ত উপাদানগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে কালোজিরা। সেসব ক্ষতিকর উপাদানগুলোর ধ্বংস করার মাধ্যমে যকৃত সুস্থ রাখতে সাহায্য করে এই ছোট বীজগুলো।

কিডনির সুস্থতা রক্ষা 

মূত্রথলির বিভিন্ন সংক্রমণ কিডনির কার্যকারিতা হ্রাস করে কিডনিকে অকার্যকর করে দিতে পারে। কিডনিতে পাথর হওয়া সেরম একটি সমস্যা। মূত্রথলির সংক্রমণ প্রতিকার ও কিডনির পাথর কোনোরকম চিকিৎসা ছাড়া অপসারণ করতে কালোজিরা কার্যকর একটি খাবার।

পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা সমাধানে

পেটফাঁপা, বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া, আমাশয়, পেটে ব্যথা – পেটের এসব সমস্যার সমাধানে অতীতকাল থেকে কালোজিরার ভর্তা কার্যকরী বলে ব্যবহার হয়। হজমশক্তি বাড়াতেও এটি কাজ করে।

ত্বকের যত্ন নেওয়ায়

লেবুর রস ও কালোজিরার তেল একসাথে মিশিয়ে সেটা মুখের ত্বকে নিয়মিত কয়েকদিন ব্যবহারে ব্রণ ও অন্যান্য দাগ দূর হয় অল্প সময়েই। চেহারার উজ্জ্বলতাও বৃদ্ধি পায়। দেহের ফুসকুড়ি, খোসপাঁচড়া, দাদ রোগের চিকিৎসায় কালোজিরা অব্যর্থ ওষুধের মতো কাজ করে।

মাথা ব্যথার উপশম 

মাথা ব্যথা দূর করতে কালোজিরার তেলের ব্যবহার এখন প্রচলিত। মাথার তালুতে এই তেল কিছুক্ষণ মালিশ করলে ব্যথা থেকে দ্রুত আরাম পাওয়া যায়।

বাত ব্যথা উপশমে

শরীরের কোথাও ব্যথা হলে সেখানে কালোজিরার তেল একটু গরম করে মালিশ করলে ব্যথা উপশম হবে। এটাও প্রচলিত একটি পদ্ধতি।

চুলের ঝরে পড়া রোধ করে

মাথার ত্বকে রক্ত সঞ্চালন বাড়ানোর মাধ্যমে চুলের গোড়ায় পর্যাপ্ত পুষ্টি পৌঁছাতে পারে। ফলে চুলের ঝরে পড়া বন্ধ করা নিয়মিত কালোজিরার তেল ব্যবহারে। এই যুগে মানুষের দুশ্চিন্তার এক কারণ হচ্ছে অতিরিক্ত চুল পড়া। যারা চুল পড়ার চিন্তায় চিন্তিত, তারা নিয়মিত কালোজিরা খান এবং মাথায় এর তেল ব্যবহার করুন। ভালো ফল পাবেন।

মেয়েদের অনিয়মিত পিরিয়ডের সমাধান

মেয়েরা প্রায়ই অনিয়মিত পিরিয়ডের সমস্যায় পড়ে। তাদের এই সমস্যা দূরীকরণে কালোজিরা হতে পারে কার্যকর। এই সমস্যা দূর করে নিয়মিত পিরিয়ড হওয়াতে চাইলে দিনে ২-৩ বার কালোজিরার তেল খেতে হবে কাঁচা হলুদের রসের সাথে মিশিয়ে।

যৌন ক্ষমতা বাড়ায়

বীর্যে শুক্রাণুর পরিমাণ বাড়াতে ও বীর্য আরও গতিশীল করতে কালোজিরার অবদান বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করতে পেরেছেন। বীর্যে শুক্রাণুর উপস্থিতি বেশি থাকলে সন্তান জন্মদানে তা সহায়তা করে। রক্ত চলাচল ভালো রাখে বলে নারী ও পুরুষের যৌন সক্ষমতাও ভালো হয়।

নারীর স্তনে দুধ উৎপাদনে

যেসব নারীরা সন্তান জন্ম হওয়ার পর স্তনে পর্যাপ্ত দুধ পান না, তারা নিয়মিত কালোজিরার ভর্তা খেলে অল্প কিছুদিনের মধ্যে স্তনে দুধের পরিমাণ বাড়বে। এটা পরীক্ষিত।

মুখগহ্বরের সুরক্ষায়

মাড়ি ফুলে যাওয়া, দাঁতে ব্যথা, গলা ব্যথা, জিহ্বায় আবরণ পড়া – এসব সমস্যা প্রতিকার করতে কুসুম গরম পানিতে কালোজিরার গুঁড়া মিশিয়ে তা দিয়ে কুলকুচি করুন। ভালো ফলাফল মিলবে। মুখে রুচি বাড়াতেও কালোজিরা খাওয়ার প্রচলন আছে।

সর্দি-কাশি সারাতে 

সর্দি লেগে নাক বন্ধ হয়ে গিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট হলে অনেককে দেখা যায় কালোজিরার ভর্তা খেতে। কালোজিরা খেলে দেহে তাপ উৎপাদনের মাধ্যমে সর্দি-কাশির কারণে সৃষ্টি হওয়া সমস্যা দূরীভূত হয়।

কীভাবে কালোজিরা খেলে উপকার মিলবে?

এটি একটি বীজজাতীয় খাবার হওয়ায় পুরো দানা আকারে, গুঁড়া করে, ভর্তা বানিয়ে, তেল বানিয়ে খাওয়া যায়। বাহ্যিক ব্যথা ও ক্ষতের চিকিৎসায় তেল আকারে ব্যবহার করা উত্তম।

শুধুমাত্র কালোজিরা না খেয়ে, এর সাথে অন্যান্য খাবার যেমন- মধু, হলুদ, পান, দই, পানির সাথে মিশিয়েও খেতে পারবেন। তাতে এর কার্যকারিতা আরও বেড়ে যায়।

কালোজিরার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া 

সম্ভব হলে যেকেউ তিন বেলায়ই কালোজিরা খেতে পারবে। ছোটদেরও খাওয়াতে পারবে। কিন্তু যাদের এলার্জি আছে, তাদের সতর্ক থাকতে হবে। অতিরিক্ত খেলে বুক জ্বালাপোড়া করা, বমি হওয়ার মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।

গর্ভবতী নারীদের কালোজিরা না খাওয়া ভালো। কারণ, গর্ভকালীন সময়ের দ্বিতীয় ভাগ থেকে ঘনঘন কালোজিরা খেলে অকালে সন্তানপ্রসব হওয়ার সম্ভাবণা আছে। তাই সে সময়ে কালোজিরা না খেলে ভালো হয়। তবে সন্তান জন্মের পর কালোজিরার উপকারিতা ভালোভাবেই পাওয়া যাবে।

কালোজিরার উপকারিতা

 

 

 

 

শেষ কথা

কালোজিরা সবার জন্যই উপকারী। সকল রোগের কার্যকর ওষুধ বলে এর ব্যবহার হয়ে থাকে খাবার হিসেবে, ওষুধে। 

এর কোনো ক্ষতিকর দিক নেই। তবে অতিরিক্ত খাওয়ার ফলে কারও কারও মধ্যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে।

নিয়মিত কালোজিরা খান, নানান রোগ থেকে মুক্ত থাকুন।

আরো পড়ুন >>  মধু খাওয়ার উপকারিতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *