বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য রচনা

বাংলাদেশের ইতিহাস ৪০০ বছরেরও পুরনো। ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনামল থেকে রচিত হচ্ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহ। যা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে শেষ হয় এবং বাংলাদেশ হয় একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। কিন্তু এই স্বাধীনতা সহজে আসেনি। অনেক ত্যাগ ও সংগ্রামের মাধ্যমেই অর্জিত হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে একাধিক ব্যক্তি ও আন্দোলনের অবদান।

এই আলোচনায় তুলে ধরা হবে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে। কে কীভাবে এই রাষ্ট্র সৃষ্টিতে অবদান রেখেছে, সেসব কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থাকছে এখানে।

বাংলাদেশের শুরুটা যেভাবে হয়

১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে ভারতবর্ষে ইংরেজদের শাসনামল শুরু হয়। ইংরেজরা নিজেদের শাসনকার্যে বিভিন্ন অন্যায়, অনিয়ম চালায়। মুসলমানদের চাইতে হিন্দুদের প্রাধান্য দিতো ইংরেজরা। এর ফলে অবিভক্ত ভারতের তৎকালীন মুসলিম সম্প্রদায় আন্দোলনের ডাক দেয়।

সেই ডাকে সংঘটিত হয়েছিল ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ, যা মুসলমানদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করেছিল। উক্ত আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হক, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রমূখ।

মুসলিমদের এই বিজয় হিন্দুরা মেনে নিতে পারছিল না। ফলে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ বাতিল করা হয়। তখন থেকেই ভারতবর্ষের মুসলিম সমাজ মুসলমান ও হিন্দুদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনের তাগিদ অনুভব করতে শুরু করে।

ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব, মুসলিম লীগ গঠন ছিল সেই সময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। অতঃপর, ১৯৪৭ সালে অনেক আন্দোলনের শেষে ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি আলাদা রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়। এ থেকেই বাংলাদেশ নামে আরেকটি রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের ইতিহাস রচিত হওয়া শুরু।

কেননা, বিভক্ত ভারতবর্ষের পাকিস্তান অংশে ভিন্ন ভাষাভাষীর জাতিগোষ্ঠী ছিল। উর্দু ভাষাভাষী ও বাংলা ভাষাভাষীর সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল পাকিস্তান। কিন্তু নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের নেতারা তাদের কথা রাখেনি। তারা জোর করে উর্দুকে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল বাংলা ভাষাভাষী মানুষের উপর। তখন থেকেই বীজরোপণ হয় বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার।

বাংলাদেশের ইতিহাস : ১৯৪৭-১৯৭১ 

পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা অংশের মানুষের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন শাসন, জোর করে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার – এসব কাজে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ চিন্তিত হয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন নেতারা একটি দল গঠন করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল বাংলার অধিকার আদায় করা। তাই মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালে গঠিত হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ।

বাংলা ভাষাভাষী জনগণের অধিকার আদায়ে এই দলটি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিভিন্ন আন্দোলনে জড়িত ছিল।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর পশ্চিম পাকিস্তানীরা প্রথম আঘাত হানে পূর্ব পাকিস্তানের ভাষার উপর। যার ফলে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত হয় ভাষা আন্দোলন। সেই আন্দোলনে রফিক, জব্বার, বরকত সহ একাধিক তরতাজা প্রাণ রাস্তায় শহীদ হয়। অবশেষে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সরকার বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেয়। ভাষা আন্দোলনই ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম আন্দোলন।

বাংলাদেশের ইতিহাস

যুক্তফ্রন্ট, ছয় দফা ও গণ অভ্যুত্থান 

পূর্ব বাংলার মানুষ যখন বুঝতে পারলো পশ্চিম পাকিস্তান কখনও বাংলার মানুষের স্বাধীনতা দিবে না। তখন থেকে তারা বিভিন্ন আন্দোলন শুরু করে। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে আওয়ামী মুসলিম লীগের বিজয়ে বাঙালির অধিকার কিছুটা হলেও প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ হয়। কিন্তু স্বৈরাচারী আইয়ুব খান সরকার নিজের ইচ্ছামতো রাষ্ট্র পরিচালনা করতে থাকে।

১৯৬৬ সালে হয় ছয় দফা আন্দোলন। যে আন্দোলনের প্রথম দফাটি ছিল বাংলাদেশ নামক আলাদা ভূখণ্ডের অনুমতি। শেখ মুজিবুর রহমান এই আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। যা আইয়ুব খান সহ্য করতে পারেনি। শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ১৯৬৮ সালে ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে পূর্ব বাংলার এই নেতাকে প্রতিহত করতে চেয়েছিল আইয়ুব সরকার। কিন্তু জনগণের আন্দোলনের মুখে তা সম্ভব হয়নি।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী জহুরুল হককে হত্যা করায় জনগণ আরও ফুঁসে ওঠে। ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থান ও আন্দোলনের মুখে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পতন হয় এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে শেখ মুজিবুর রহমান সহ অন্যান্য বন্দীরা মুক্তি পায়। জেল থেকে মুক্তির পর শেখ মুজিবুর রহমানকে “বঙ্গবন্ধু” উপাধিতে ভূষিত করে বাংলার জনগণ।

পদত্যাগে বাধ্য হয়ে আইয়ুব খান তখন ক্ষমতা হস্তান্তর করে ইয়াহিয়া খানের হাতে। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় আসার পরই সংঘটিত হয় ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড।

৭০-এর নির্বাচন

ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় এসে সকল ধরণের রাজনৈতিক কার্যক্রম স্থগিত করে দেয়। দেশে সুষ্ঠুতা ফিরিয়ে আনতে ১৯৭০ সালে নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া হয়। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে জয়ী হয়। 

নির্বাচনে বিজয় লাভের পর আওয়ামী লীগ তখন পূর্ব পাকিস্তানকে সম্পূর্ণ আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে সাজানোর প্রস্তুতি শুরু করে। পাকিস্তানের দুই অংশের আলাদা সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার সুযোগ পায়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন

আওয়ামী লীগের বিজয়ে পাকিস্তান সরকার খুশি হতে পারেনি। তাই ১৯৭১ সালের মার্চের ১ তারিখে আওয়ামী লীগের অধিবেশন বাতিল করে দেয়। ফলে বাংলায় তখন বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। কিন্তু পাকিস্তান সরকার তা গ্রাহ্য করেনি।

পাকিস্তান সরকারের আচরণে আশাহত হয়ে ১৯৭১ সালের ৭-ই মার্চ পূর্ব বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। যা বাংলার জনগণকে নিজেদের অধিকার আদায়ে প্রতিবাদী করে তুলে। 

সেই ভাষণে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের চালানো অন্যায়, অত্যাচারের কথা তুলে ধরেন। এবং নিজেদের স্বাধীনতা অর্জনে আসন্ন এক যুদ্ধের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণকে সচেতন থাকার আহবান জানান। তাঁর আহবানে বাঙালি লড়াই করার প্রেরণা লাভ করে।

২৫-শে মার্চ গভীর রাতে পূর্ব পাকিস্তানের ঘুমন্ত নিরীহ জনগণের উপর নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ২৬-শে মার্চের প্রথম প্রহরে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তাঁর ঘোষণায় বাংলার সকল শ্রেণি ও বয়সের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে।

মুজিবনগর সরকার  বাংলাদেশের ইতিহাস

মুক্তিযুদ্ধ সঠিকভাবে পরিচালনা করতে ১৯৭১ সালের ১০-ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার নামে এক অস্থায়ী সরকার গঠন করা। যে সরকারের প্রধান রাষ্ট্রপতি করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে। শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি করা হয় সৈয়দ নজরুল ইসলামকে। প্রধানমন্ত্রী করা হয় তাজউদ্দীন আহমদকে।

মুজিবনগর সরকার মুক্তিযুদ্ধকে সহজ ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে সমগ্র বাংলাদেশকে ১১ টি সেক্টরে বিভক্ত করে।

বাংলাদেশের ইতিহাস

বাংলাদেশের অভ্যুদয় 

দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬-ই ডিসেম্বর পাকিস্তান হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। ৯০ হাজারেরও অধিক সদস্য নিয়ে হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় স্বাধীন বাংলাদেশের। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ পায় একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াবার সুযোগ।

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে অনেক সহায়তা করেছে ভারত। আশ্রয়কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, মুক্তিবাহিনী গঠনের মতো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে পার্শ্ববর্তী দেশটি।

স্বাধীন  বাংলাদেশের ইতিহাস

১৬-ই ডিসেম্বর বিজয় লাভের মাধ্যমে বাংলাদেশ হয় পাকিস্তানি শাসন মুক্ত সম্পূর্ণ নতুন এক রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্রকে গঠন করার দায়িত্ব শেখ মুজিবুর রহমানের। ১৯৭২ সালের ১০-ই জানুয়ারি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে তিনি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠন করার কাজ শুরু করেন।

সরকার গঠন, সংবিধান তৈরি করে দেশের মানুষের কষ্ট লাঘব করতে তিনি সকল ব্যবস্থা নিয়েছেন। তাই তো বাংলাদেশ এখন একটি স্বাধীন ও সাহসী রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান পেয়েছে।

বাংলাদেশের ইতিহাস অনেক গৌরবের ইতিহাস। এই দেশটি সহজে আসেনি। ৩০ লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে পরম কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। এর পেছনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন মূল কারিগর। তাই তো বাঙালি জাতি আজও এই মহান নেতাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।

আরো পড়ুন >>  সূরা আর রহমান এর ফজিলত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *