সুচিপত্র
ন্যাচারাল সুগারে ভরপুর একটি খাবার মধু। আদিমকাল থেকেই খাদ্যের পাশাপাশি চিকিৎসার কাজেও ব্যবহার হয়ে আসছে। ফুল থেকে ফুলে ঘুরে মৌমাছিরা মধু সংগ্রহ করে এবং তা মানুষের জন্য স্বত্বত্যাগ করে দেয়। সেই মধু থেকে উপকৃত হয় মানবজাতি। জানেন কি, মধু খাওয়ার উপকারিতা কী কী? অসংখ্য পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ মধু বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার হয়। জটিল জটিল রোগ প্রতিকার করতেও মধু অনেক কার্যকর।
এই আর্টিকেলে জেনে নিন, মধুর পুষ্টিগুণ ও মধু খাওয়ার উপকারিতা সম্পর্কে।
মধু যত পুষ্টিগুণে ভরপুর
দেখতে সহজলভ্য হলেও ৫০ গ্রাম মধু উৎপন্ন করতে একটি মৌমাছির সারাজীবন লেগে যায়। মৌমাছি যতদিন বাঁচে, সেই সময়টুকু সে মধু আহরণে ব্যয় করে মানবজাতিকে অমূল্য এক বস্তু দিয়ে যায়।
ক্ষতিকারক কোনো উপাদান নেই, যা আছে তা পুরোটাই উপকারী। মধুর গুণাগুণ একাধিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে।
মধুতে রয়েছে – ভিটামিন, শর্করা, এমিনো এসিড, জিংক, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, নিয়াসিন, শূন্য মাত্রায় ফ্যাট, স্বাস্থ্যকর ক্যালরি, রিবোফ্লাভিন ও বিভিন্ন এন্টিঅক্সিডেন্ট।
এই উপাদানগুলো মধুকে করেছে এক মহৌষধি বস্তুতে।
মধু খাওয়ার উপকারিতা
সম্পূর্ণ নিরাপদ খাবার হিসেবে মধুকে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু তা হতে হবে খাঁটি মধু। শুধুমাত্র খাঁটি অর্থাৎ প্রকৃত মধু থেকেই পরিপূর্ণ গুণাগুণ পাওয়া যায়।
মধু খাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ কিছু উপকারিতা এখানে উল্লেখ করা হলো-
১. দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করে
আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে উন্নত ও শক্তিশালী করতে প্রয়োজন এন্টিঅক্সিডেন্ট। মধুতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু এন্টিঅক্সিডেন্ট বিদ্যমান থাকায় তা মানবদেহের ইমিউনিটি সিস্টেমকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। ফলে সহজে কোনো রোগ আক্রমণ করতে পারে না। যেকোনো রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বিভিন্ন উপকারী কোষ আমাদের দেহে রয়েছে। সেই কোষগুলোকে শক্তিশালী করে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে তোলে মধু।
২. পরিপাকতন্ত্র সুস্থ রাখে
আদিকাল থেকে পেটের বিভিন্ন অসুখের চিকিৎসায় মধুর ব্যবহার আজও প্রচলিত। পেটে গ্যাসের সমস্যা, বদহজম, ডায়রিয়া, আমাশয়, কোষ্ঠকাঠিন্য – এসমস্ত পেটের অসুখের নিরাময় করতে মধু অনেক কার্যকর। খালি পেটে এক-দুই চামচ মধু খাওয়ার ফলে পরিপাকতন্ত্রের সকল সমস্যা দূর হয়ে যায়।
৩. শ্বাসকষ্ট কমায়
যাদের হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট রয়েছে তাদের জন্য মধু একটি অত্যন্ত উপকারী ওষুধ। নাকের সামনে মধু রেখে শ্বাস টানার মাধ্যমে ফুসফুসের এসব সমস্যায় আক্রান্ত রোগী ভালোভাবে শ্বাস নিতে সক্ষম হয়।
৪. হৃদরোগের চিকিৎসায়
হৃদপিণ্ডের পেশির স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু রাখতে এন্টিঅক্সিডেন্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এন্টিঅক্সিডেন্ট রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে বিধায় হৃদপিণ্ড স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ সেসব এন্টিঅক্সিডেন্ট মধুতে বিদ্যমান। ফলে মধু খাওয়ায় হৃদপিণ্ড ভালো থাকে, বিভিন্ন হৃদরোগ থেকে বাঁচা যায়।
৫. যৌন ক্ষমতা উন্নত করে
এন্টিঅক্সিডেন্ট মানুষের যৌন স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয়। লিঙ্গ উত্থান না হওয়া, যৌন সম্পর্ক স্থাপনের সময় লিঙ্গ শক্ত না হওয়ার সমস্যায় ভোগা পুরুষদেরকে লিঙ্গে মধু মালিশ করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এটা আসলেই কার্যকর বলে যৌন চিকিৎসকরা মতামত দিয়ে থাকে। নারী ও পুরুষ সবার যৌন সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে মধু সাহায্য করে।
৬. ত্বকের যত্নে
মেয়েরা রূপচর্চা করতে মধু মুখে ব্যবহার করে। মধু দিয়ে মাস্ক বানিয়ে তা মুখে লাগিয়ে রাখে। এটি একটি পরিচিত রূপচর্চা। এর ফলে ত্বকে মসৃণতা বিরাজ করে, ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায় ও ত্বক হয় কোমল। ব্রণের চিকিৎসায়ও মধু কার্যকর।
৭. চেহারায় সতেজতা ধরে রাখে
অল্প বয়সেই চেহারায় বয়স্কদের মতো অবস্থা দেখা যায় অনেকের। চামড়ায় দাগ, কুঁচকে যাওয়া, মলিন ও ফ্যাকাসে ভাব থাকায় চেহারায় বয়স্কদের মতো ছাপ দেখা যায়। নিয়মিত মধু খাওয়া ও মুখের ত্বকে মধু লাগানোর মাধ্যমে এই সমস্যা দূর করা যায়। মধুর এন্টিঅক্সিডেন্ট চেহারার তরুণ অবস্থা, সতেজতা ধরে রাখতে সহায়তা করে।
৮. দাঁত এবং হাড়ের সুরক্ষায়
ক্যালসিয়াম হাড় এবং দাঁত গঠনে প্রয়োজন। মধুতে ক্যালসিয়াম রয়েছে। যা শিশু ও বড়দের দাঁত, হাড় ও নখের গঠন শক্তিশালী করে, ক্ষয়রোধে কাজ করে। দাঁত ও নখের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করতেও ক্যালসিয়াম কাজ করে। হাড় ও নখের ভঙ্গুরতা প্রতিরোধেও ক্যালসিয়াম অবদান রাখে।
৯. ওজন কমানোয় উপকারী
অতিরিক্ত ওজনের কারণে যারা চিন্তিত, তারা প্রতিদিন মধু খাওয়ার মাধ্যমে ওজন ঝরাতে পারেন। কারণ, মধু জিরো ফ্যাট সমৃদ্ধ অর্থাৎ মধুতে কোনো ফ্যাট নেই। মানুষের ওজন বাড়ার পেছনে ফ্যাট দায়ী। মধুতে ফ্যাট না থাকায় এটি আপনার ওজন কমাতে সাহায্য করবে।
১০. রক্তশূন্যতা দূর করে
ম্যাঙ্গানিজ ও আয়রন রক্তে হিমোগ্লোবিন উৎপন্ন করে। ফলে দেহে রক্ত স্বাভাবিক থাকে এবং রক্তশূন্যতা থেকে মুক্ত থাকা যায়। রক্তের প্লাটিলেট বৃদ্ধি করতেও এই উপাদানগুলো কার্যকর।
১১. পানিশূন্যতা দূর করে
ডায়রিয়া, আমাশয় হলে দেহে পানির ঘাটতি তৈরি হয়। অতিরিক্ত ঘামের কারণেও পানি শরীর থেকে বের হয়ে গিয়ে পানিশূন্যতার সৃষ্টি করে। মধু এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ দিয়ে থাকে।
১২. মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে
এন্টিঅক্সিডেন্ট ও পটাশিয়াম মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং স্মৃতিশক্তি বাড়াতে কাজ করে।
১৩. মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখে
ডিপ্রেশন, মানসিক চাপ, মনমরা ইত্যাদি মানসিক অবস্থা কাটাতে মধুর এন্টিঅক্সিডেন্ট দারুণ কার্যকর।
১৪. শরীরে শক্তি বাড়ায়
শরীরে তাপ উৎপন্নের মাধ্যমে শারীরিক শক্তি বাড়াতে মধু কাজ করে। সকালে এক-দুই চামচ মধু খেয়ে নিলে সারাদিন বিভিন্ন শারীরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সচল থাকে। কাজ করার শক্তি পাওয়া যায়।
১৫. ঠাণ্ডা, সর্দি-কাশির উপশম করে
মধু খেলে দেহে তাপশক্তি উৎপন্ন হয়। তাই ঠাণ্ডাজনিত রোগ দ্রুত সারিয়ে তোলা যায়।
১৬. মুখগহ্বরের সুস্থতায়
মুখের ভিতরে ঘা, ক্ষত, কেটে যাওয়া, মাড়ি ফোলা – মুখগহ্বরের এই সমস্যাগুলো সারিয়ে তুলতে মধু খুবই উপকারী।
১৭. রক্ত বিশুদ্ধিকরণে
লোহিত রক্তকণিকার সংখ্যা বৃদ্ধিতে মধু গুরুত্ব বহন করে। সাথে রক্ত থেকে ক্ষতিকর পদার্থ অপসারণ করে রক্ত বিশুদ্ধ করতে মধুর উপাদানগুলো কার্যকরী।
১৮. উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ করে
এন্টিঅক্সিডেন্ট রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখে। রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থাকলে উচ্চ রক্তচাপের মতো মারাত্মক রোগ মুক্ত থাকা যায়। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে মধু খেলে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
১৯. ভালো ঘুম হয়
একটু মধু খাওয়ার পর দেখবেন ঘুমঘুম ভাব হয়। এটা ভালো ঘুম হতে সাহায্য করে। যারা ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না৷ অনিদ্রায় ভুগছেন, তারা ঘুমাতে যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে কয়েক চামচ মধু খেয়ে নিবেন। তাতে ভালো ঘুম হবে।
কীভাবে মধু খাওয়া উচিত?
মধু মুখে খাওয়াও যায়, আবসর বাহ্যিকভাবেও ব্যবহার করা যায়। সর্দি-কাশিতে গরম পানির সাথে মধু মিশিয়ে খেলে দ্রুত ফলাফল পাওয়া যায়। মধুর সাথে ছোলা খাওয়ায় যৌন ক্ষমতার উন্নতি হয়। শুধু মধু খাওয়া যায়, অথবা সম্ভব হলে অন্যান্য খাবারের সাথে মিশিয়েও খাওয়া যাবে। মধু দিয়ে মুখরোচক বিভিন্ন খাবার তৈরি করে খেলেও এর উপকারিতা বজায় থাকে।
দেহের কোথাও ফোলা, ক্ষত হলে আহত স্থানের উপর কিংবা আশেপাশে মধু মেখে দিলে অল্প সময়ের মধ্যে ব্যথা ও ফোলা কমতে শুরু করে। যৌনাঙ্গে মধু মাখলে যৌনাঙ্গের পেশিগুলো শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
মধু খাওয়ার উপকারিতাসমূহ বাচ্চা থেকে শুরু করে বৃদ্ধ যেকেউ পেতে পারে। তবে অবশ্যই সীমিত পরিমাণে খেতে হবে। উপকারী খাবার বলেই অতিরিক্ত খাওয়া ঠিক নয়। সবকিছুরই নির্দিষ্ট সীমা থাকে। সীমা ছাড়িয়ে গেলে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিয়ে থাকে। মধুর ক্ষেত্রেও তাই।
এত গুণাগুণ সমৃদ্ধ এই মিষ্টি খাবারটির সঠিক কার্যকারিতা পেতে চাইলে অবশ্যই খাঁটি মধু ব্যবহার করতে হবে। বাজারে কৃত্রিম ও ভেজালযুক্ত মধু বেশি থাকে। তাই মধু কেনার আগে যাচাই করে আসল মধু কিনতে হবে।
আরো পড়ুন >> আজওয়া খেজুর ও খেজুরের উপকারিতা