মাগরিবের পর সূরা ওয়াকিয়া পড়ার ফজিলত

সূরা ওয়াকিয়া পবিত্র কুরআনের অন্যতম ফজিলতপূর্ণ একটি সূরা যাতে কিয়ামত দিবসের উপর আলোকপাত করা হয়েছে। সূরা আর-রাহমান এর পরবর্তী সূরা হলো সূরা ওয়াকিয়া। পবিত্র কুরআনের প্রতিটি সূরা’র নির্দিষ্ট শানে নুযূল ও ফজিলত রয়েছে। এই সূরাটিরও তা রয়েছে। এই লেখায় সূরা ওয়াকিয়ার ফজিলত ও সূরাটির পরিচয়, আসলেই কি এই সূরা আমল করলে ফজিলত পাওয়া যায়? – এই বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

সূরা ওয়াকিয়া 

ইসলাম ধর্মের সর্বশেষ নবী ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল হযরত মুহাম্মদ সাঃ ৬২২ সালে মদীনায় হিজরত করার ৭ বছর আগে এই সূরাটি মক্কায় নাযিল হয়। মক্কায় নাযিল হওয়ায় এটি একটি মাক্কী সূরা। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআনের ৫৬ নাম্বার সূরা এটি। এর আয়াত (বাক্য) ৯৬ টি। ৩ অনুচ্ছেদ (রুকু) বিশিষ্ট এই সূরাটি।

“ওয়াকিয়া” শব্দের অর্থ “এমন ঘটনা যা নিশ্চিত ঘটবে”। অর্থাৎ কিয়ামত। দুনিয়ার ধ্বংস অনিবার্য। আল্লাহ্ ছাড়া কেউ জানে না কখন এই দুনিয়া ধ্বংস হবে। কিয়ামত দিবসের বর্ণনা দিয়েই মহান আল্লাহ্ তা’আলা এই সূরাটি অবতীর্ণ করেন। এর আগের সূরা হচ্ছে সূরা আর-রাহমান, পরবর্তী সূরা হচ্ছে সূরা হাদীদ।

সূরাটি নাযিল হওয়ার কারণ

মহানবী সাঃ এর সেই যুগে আরবের অবস্থা ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন, বর্বর। কাফেররা বিভিন্ন পাপাচারে মজে থাকতো। মৃত্যু ও পরকাল নিয়ে কারও মধ্যে কোনো অনুভূতি ছিল না। ইসলামকে তারা হাসিঠাট্টার বিষয় বলে উড়িয়ে দিত। তা মহানবী সাঃ সহ তাঁর অন্যান্য সাহাবিদের ব্যথিত করে।

কাফেরদের হাসিঠাট্টা, সন্দেহ দূর করতে মহান আল্লাহ্ তা’আলা তখন সূরা ওয়াকিয়া নাযিল করেন। যেখানে কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার সুস্পষ্ট বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। কিয়ামত হবে, মানুষকে পুনরায় জীবিত করা হবে, পরকালে সবার কৃতকর্মের হিসাব নেওয়া হবে। সুফল প্রাপ্তদেরকে জান্নাত দেওয়া হবে, আর পাপের শাস্তি হিসেবে জাহান্নামে দেওয়া হবে। 

কিয়ামত নিশ্চিত ঘটনা। তা হবেই। কেউ তা থামাতে পারবে না। এই সূরার মাধ্যমে এই হুশিয়ারিই আল্লাহ্ তা’আলা বান্দাদের দিতে চেয়েছেন।

সূরা আর-রাহমানে পূণ্যবানদের জন্য জান্নাতের ঘোষণা দিয়ে জান্নাতের যাবতীয় বর্ণনা দেওয়ার পর, সূরা ওয়াকিয়া-তে আল্লাহ্ তা’আলা পরকালে অবিশ্বাসীদের জন্য শাস্তির কথা বর্ণনা করেছেন। যাতে মানুষ পরকালের জীবন নিয়ে সাবধান হতে পারে।

যারা প্রকৃত মুমিন মুসলমান, তাদের জন্য সুখবরও দেওয়া হয়েছে এতে। আল্লাহ’র ক্ষমতার সুনিপুণ বর্ণনাও রয়েছে। যখন কিয়ামত হবে সেদিন পৃথিবীর অবস্থা কেমন হবে সে বিষয়ে বান্দাদের অবহিত করা হয়েছে।

প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে ভূমিকম্প হবে, পাহাড়গুলো নরম সাদা তুলোর মতো উড়তে থাকে। দুনিয়ার মানুষ অসহায়ের মতো ছুটাছুটি করতে থাকবে। কেউ সেই মুহুর্তকে থামাতে পারবে না। পুরো পৃথিবী লণ্ডভণ্ড হবে, সকল প্রাণীর মৃত্যু হবে। মৃত্যুর পর মানুষকে আবারও জীবিত করবেন বিচার দিনের মালিক আল্লাহ্। জীবিত করার পর যার যার কর্ম অনুসারে জান্নাত ও জাহান্নামে দিবেন।

সূরা ওয়াকিয়া
সূরা ওয়াকিয়া

সূরা ওয়াকিয়া এর  আয়াত সমূহের বিষয়বস্তু

৯৬ আয়াত বিশিষ্ট সূরাটি কয়েকটি ভাগে ভাগ করা। বোঝার সুবিধার্থে এখানে আয়াতের বিষয়বস্তু গুলো ক্রমানুযায়ী উল্লেখ করা হলো।

আয়াত ১ -২ : সূরার শুরুতে অনিবার্য সেই দিন, নিশ্চিত সেই ঘটনা কিয়ামতের কথা বলা।

আয়াত ৩-৭: কিয়ামত কীভাবে সংঘটিত হবে, পৃথিবীর কীরূপ অবস্থা হবে সেদিন, সেই মুহুর্তের ভয়াবহ বিবরণ দিয়েছেন আল্লাহ্ তা’আলা। 

আয়াত ৮-১১: কিয়ামতের দিন মানুষ তিনটি দলে বিভক্ত হবে। নিজেদের করা কৃতকাজ অনুযায়ী দল তিনটি নির্ধারিত হবে। একদল হবে পূণ্যবান বান্দাদের নিয়ে, দ্বিতীয় দল হবে যারা সৌভাগ্যবান, তৃতীয় দল হবে দূর্ভাগা বান্দাদের যারা ইসলাম ও পরকাল বিশ্বাস করতো না।

আয়াত ১২-৩৯: জান্নাতে পূণ্যবান ও সৌভাগ্যবান বান্দারা কেমন থাকবে সেই বিশদ বর্ণনা। যারা তাওহীদে বিশ্বাসী, প্রকৃত মুমিন ছিল, যারা সৎকাজ করেছে – তাদের জন্য জান্নাতের সুসংবাদ এবং জান্নাতের অবস্থা কেমন তা সূরাটির এই ভাগে আলোচনা করা হয়েছে।

আয়াত ৪০-৫৬: এই আয়াত সমূহে জাহান্নামের কথা বলা আছে। তাওহীদ তথা আল্লাহ’র একত্ববাদে অবিশ্বাসী, পাপী, দূর্ভাগাদের বিষয়ে বলা হয়েছে এবং শাস্তিস্বরূপ জাহান্নামের নির্মম ও ভয়াবহ অবস্থা বর্ণিত এই ভাগে।

আয়াত ৫৭-৭৩: এই পৃথিবী ধ্বংস হবে এবং তা কেউ আটকাতে পারবে না। পৃথিবীতে সেদিন প্রকট ভূমিকম্প হবে, পাহাড় সমূহ তুলোর ন্যায় শূন্যে ভাসতে থাকবে, দুনিয়ার অভ্যন্তরস্থ সকল কিছু চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে। সকল প্রাণী মারা যাবে। তারপর আল্লাহ্ তা’আলা মানুষকে আবার জীবিত করবেন। মাটি থেকে চারা গাছের মতো মানুষ উঠতে থাকবে। আল্লাহ্ মানুষকে কীভাবে সৃষ্টি করেছেন, আবার কীভাবে মৃত্যুর পর জীবিত করবেন এসব যুক্তিগুলো সূরার এই অংশে তুলে ধরা হয়েছে।

আয়াত ৭৪-৮১: এই অংশে আল্লাহ্ তা’আলা পবিত্র কুরআনের সত্যতা নিশ্চিত করতে তাঁর সৃষ্ট বস্তুর কসম করেছেন। আকাশের তারার শপথ করে আল্লাহ্ কুরআনের বিশুদ্ধতা প্রকাশ করেছেন। কুরআন সত্য। কুরআন আল্লাহ্ তা’আলার বাণীসমূহের সুস্পষ্ট প্রমাণ। কুরআনে কোনো ভুল নেই। কুরআন অনুসরণ করে জীবন অতিবাহিত করলে আল্লাহ’র নৈকট্য পাওয়া যায়।

আয়াত ৮২-৯৬: এই ভাগই সূরার শেষ ভাগ। সকল প্রাণীই মরণশীল। মৃত্যুকে কেউ নিবারণ করতে পারবে না। যেহেতু মৃত্যুই মানুষের অনিবার্য পরিণতি, সেহেতু মানুষের উচিত আল্লাহ্ তা’আলার উপর বিশ্বাস করা, আল্লাহ’র বিধান মেনে চলা, তাওহীদে বিশ্বাস স্থাপনের মাধ্যমে পরিপূর্ণ মুসলমান হওয়া। মৃত্যুর পর মানুষকে পরকালে জবাবদিহি করতে হবে। আল্লাহ’র দেওয়া জীবনকে কীভাবে ও কী কাজে ব্যবহার করেছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব দিতে হবে। 

যাদের আমলনামা ভালো হবে, তাদেরকে পুরষ্কার হিসেবে জান্নাত দেওয়া হবে। আর যাদের আমলনামা হবে পাপে ভারী, তাদেরকে জাহান্নামের লেলিহান আগুনে নিক্ষেপ করা হবে। তাই, পরকালে সফলকাম হতে চাইলে অবশ্যই তাওহীদে বিশ্বাস করতে হবে। সূরার শেষে এই বার্তাই দেওয়া হয়েছে সমগ্র মানবজাতিকে।

সূরা ওয়াকিয়া

সূরা ওয়াকিয়ার ফজিলত কী?

পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআনের সকল সূরারই নিজস্ব ফজিলত রয়েছে। কুরআনের একটি হরফ বা অক্ষর উচ্চারণ করলেও আল্লাহ্ তা’আলা নেকি দান করেন। তাহলে, কেউ যদি কুরআনের কোনো সূরা পাঠ করে, তাহলে অবশ্যই সে অনেক নেকি ও সওয়াবের অধিকারী হবে।

সূরা ওয়াকিয়ারও সেরকম ফজিলতের কথা বিশিষ্ট আলেম ওলামাদের কাছে শুনতে পারা যায়।

সূরা ওয়াকিয়ার ফজিলত বিষয়ে যে হাদিসটি বেশি প্রচলিত আছে, সেটা হলো- 

তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান (রা.) – এর সময়ে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ নামের এক ব্যক্তি ছিলেন। একদিন মাসুদ অসুস্থ হয়ে বিছানায় শোয়া ছিল। হযরত উসমান (রা.) তাঁকে দেখতে যান। হযরত উসমান (রা.) তখন মাসুদকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ কোনো সাহায্য গ্রহণ করতে চাননি।

মৃত্যুশয্যায় নিজের মেয়েদেরকে কোনো সম্পদ দিয়ে যেতে পারছে না দেখে কেউ কেউ তাচ্ছিল্যের সাথে তাঁকে তিরস্কার করছিল। তা শুনে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ বলেন,-” আমি আমার মেয়েদেরকে সম্পদ হিসেবে সূরা ওয়াকিয়া রেখে যাচ্ছি। কারণ, আমি একদা হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর কাছে শুনেছিলাম যে, কেউ যদি প্রতিরাতে সূরা ওয়াকিয়া তিলাওয়াত করে, তাহলে দারিদ্রতা তাকে স্পর্শ করবে না।”

অর্থাৎ, এই হাদিস থেকে জানা যায়, আর্থিক কষ্ট দূর করতে প্রতি রাতে সূরা ওয়াকিয়া আমল করলে ফজিলত পাওয়া যায়।

আসলেই কি ফজিলত পাওয়া যায়? 

উক্ত হাদিসটি বিষয়ে একাধিকবার মতবাদ রয়েছে। একদল বিশিষ্ট আলেম ও হাদিসে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা হাদিসটিকে শুদ্ধ হাদিস বলেন না। অর্থাৎ, মহানবী সাঃ এই কথা বলেছিলেন তা প্রমাণিত নয়।

মতবাদ যাইহোক, কুরআন পবিত্র গ্রন্থ। এই গ্রন্থ তিলাওয়াত করলে অশেষ নেকি ও সওয়াব পাওয়া যায়। 

উপরিউক্ত আমলে ফজিলতের কথা কুরআনে উল্লেখ না থাকলেও, কেউ যদি এই আমল করে তাহলে অবশ্যই সে সওয়াব পাবে। অর্থাৎ, নিয়মিত রাতে সূরা ওয়াকিয়া আমল করার কথা উল্লেখ না থাকলেও এটা আমল করা নাজায়েজ কিছু হবে না। আমল করলে নিশ্চয়ই এর মূল্য পাওয়া যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *