সুচিপত্র
খাবারের নিয়মিত একটি উপকরণ রসুন। এর মূল কাজ খাবারের স্বাদ বৃদ্ধি। কিন্তু অনেকেই জানে না রসুনের উপকারিতা কত। যৌন ক্ষমতা বাড়ানো এমনকি আয়ু বাড়ানোর মতো অনেক উপকার পাওয়া যায় রসুন থেকে। মধু, আদা, কালোজিরা যেমন আমাদের স্বাস্থ্যের অনেক উপকার করে, রসুনও তেমনই কার্যকর এবং উপকারী।
কীভাবে রসুন খেলে উপকার পাওয়া যাবে? কাঁচা না-কি রান্নায় রসুন খেলে বেশি উপকার? রসুন খেলে কোনো অপকারী দিক আছে কি-না – এসব বিস্তারিত জেনে নিন।
রসুনের উপকারিতা ও এর মধ্যে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদান
মশলা হিসেবেই রসুনের পরিচিতি, মশলা হিসেবেই এর ব্যবহার। মানুষ তরকারি, ভর্তার স্বাদ বৃদ্ধি করতে রসুন ব্যবহার করে। অন্যান্য কাজে রসুনের ব্যবহার দেখা যায় না তেমন।
কিন্তু আদিকালে রসুন ব্যবহৃত হতো রান্নাবান্না সহ চিকিৎসার কাজে। জটিল জটিল রোগের ঘরোয়া চিকিৎসায় রসুনের ব্যবহার ছিল ফলদায়ক। তাই, তখনকার মানুষ শুধু খাবারেই নয়, সুস্থ জীবনযাপনের জন্যও রসুনকে বেছে নিতো।
রসুন দেখতে সাদা খোলসে আবৃত গোটার মতো বস্তু। খোলসের মধ্যে ৫-১০ টি গোটা থাকে যা খোসল সরালে সহজেই আলাদা হয়ে একেকটা কোয়া হয়। বিভিন্ন জাতের রসুন রয়েছে। আকৃতিতে ছোট থেকে বড় হয়ে থাকে। রসুন মাটির নিচে জন্মায়।
স্বাদ ঝাঁঝালো আর কড়া গন্ধযুক্ত হলেও এই মশলারটির মধ্যে রয়েছে অনেক পুষ্টি উপাদান। বিভিন্ন পুষ্টি গুণাগুণে সমৃদ্ধ হওয়ায় রসুন অনেক জটিল রোগের নিরাময়েও কার্যকর।
এতে আছে – ব্যাকটেরিয়া ও প্রদাহ প্রতিরোধকারী উপাদান, ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স (ভিটামিন-বি১, ২, ৩, ৫, ৬, ৯), ভিটামিন-সি, এলিসিন, নিয়াসিন, ম্যাঙ্গানিজ, প্রোটিন, আয়রন (লৌহ), সেলেনিয়াম, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাস, কার্বোহাইড্রেট সহ আরও কিছু অ্যান্টিএক্সিডেন্ট।
এখন জেনে নিন রসুন মানবদেহের কতটা উপকার করে।
রসুনের উপকারিতা
ছোট ও বড় বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার চিকিৎসায় ঘরোয়াভাবে ও ডাক্তারি উপায়ে রসুন ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
এখানে রসুনের কয়েকটি স্বাস্থ্য উপকারিতা উল্লেখ করা হলো:-
১. দেহে রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতার উন্নতি
চিকিৎসা বিজ্ঞানে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে যে, ” খাবারকে এমনভাবে খেতে হবে যেন খাবারই আপনার ওষুধ “। অর্থাৎ এমন খাবার খেতে হবে যা খেলে আপনার দেহ থাকবে রোগ মুক্ত, শক্তিশালী হবে রোগ প্রতিরোধকারী ক্ষমতা। রসুন সেরকম একটি খাবার। রসুনে একাধিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকায় এটি একটি মহৌষধি উপাদান যা খেলে আপনার দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বুস্ট হবে। যেকোনো রোগের বিরুদ্ধে সুরক্ষার ব্যবস্থা দেহে সহজেই তৈরি হতে পারবে।
২. সর্দিকাশি নিরাময়
রসুনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গুলো সর্দিকাশির মতো সমস্যায় অধিক কার্যকর। দেহে তাপ উৎপন্ন করে দেহকে সর্দিকাশি প্রতিরোধী সামর্থ্য তৈরি করে ফলে অল্প সময়ের মধ্যে আপনি এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাবেন।
৩. হৃদপিণ্ড ভালো রাখে
অল্পতে হাঁপিয়ে যাওয়া, রক্তের অস্বাভাবিক আচরণ, বুকে ব্যথা এগুলো হৃদপিণ্ডের সমস্যার কারণে হয়ে থাকে। কোলেস্টেরল বেড়ে যাওয়া হৃদপিণ্ডের জন্য হুমকি। রসুনে বিদ্যমান এলিসিন কোলেস্টেরলকে দমিয়ে রাখে, এটা ছাড়াও অন্য উপাদানগুলোও এক্ষেত্রে সহায়তা করে। প্রতিদিন খাবারে রসুনের পাশাপাশি ২-৩ কোয়া কাঁচা রসুন খেলে হৃদপিণ্ডের পেশি আরও সবল হয়ে ওঠে, হৃদপিণ্ডের কার্যকারিতা বাড়ে। হৃদপিণ্ড ভালো রাখতে প্রতিদিন রসুন খাওয়ার অভ্যাস করা উচিত।
৪. উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ
উচ্চ রক্তচাপ একটি নিরব ঘাতক রোগ। উচ্চ রক্তচাপের কারণে ডায়াবেটিস ও হার্ট অ্যাটাক সহ হৃদপিণ্ডের জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয়। যা রোগীকে মৃত্যুর দিকে টেনে নেয়। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা গেলে অন্যান্য মারাত্মক রোগগুলো হতেও নিরাপদ থাকা সম্ভব হবে। রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখা তাই অতীব দরকারী। রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে নিয়মিত ৩-৪ কোয়া রসুন খান।
৫. মস্তিষ্ক সুস্থ রাখে
মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহে কোনো সমস্যা হলে মস্তিষ্কের সবল কোষগুলো দূর্বল হয়ে পড়ে। ফলে মস্তিষ্কে জটিল ও মারাত্মক রোগও হতে পারে। আলঝেইমার্স, ডিমেনশিয়ার মতো ভয়ংকর রোগ মস্তিষ্কের কোষের দূর্বলতার সুযোগে হতে পারে।
মূল সমস্যা অক্সিজেনের সংকট। মস্তিষ্কের এই সংকট কাটাতে রসুনের উপকারিতা প্রমাণ পাওয়া গেছে। রসুনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট অক্সিজেনের যাবতীয় সমস্যা দূর করে মস্তিষ্ককে সুস্থ রাখতে সহায়তা করে।
৬. ফুসফুস ভালো রাখে
সর্দিকাশি, নিউমোনিয়া, এলার্জি, ঠাণ্ডাজনিত সমস্যায় ফুসফুস অসুস্থ হয়ে যায়। তখন শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি সহ মারাত্মক ফুসফুসীয় সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। নিয়মিত রসুন খেলে ফুসফুসের যাবতীয় সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া যায়।
৭. যৌন ক্ষমতা বৃদ্ধিতে
অন্য কোনো শারীরিক সমস্যার চিকিৎসায় রসুনের কথা শুনে থাকুন বা না থাকুন, সেক্স পাওয়ার বাড়াতে রসুনের ব্যবহারের কথা নিশ্চয়ই শুনেছেন।
হ্যা, ঠিকই শুনেছেন। রসুন যৌন ক্ষমতা বাড়ায়। শারীরিক সুস্থতাই যৌন সুস্থতার মূল। শরীর সুস্থ না থাকলে যৌনতায় পারফরম্যান্স ঠিক থাকে না। শরীর সুস্থ রাখতে প্রয়োজন দেহে পর্যাপ্ত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। রসুন এই কাজটি করে।
৮. ত্বকের সুরক্ষা
অল্প বয়সেই বুড়িয়ে যাওয়ার সমস্যা অনেকের মাঝেই দেখা যায়। বয়স বেশি না হওয়ার পরও চেহারায় বার্ধক্যের মতো চিহ্ন দেখা যায়। চামড়া কুঁচকে যাওয়া, ভাজ পড়ার কারণে চেহারায় বয়সের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ত্বকের কোষগুলোর দূর্বলতার কারণে ত্বকে এমন হয়ে থাকে। ত্বকের কোষগঠনে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রয়োজনীয় উপাদান। যা রসুনে পাওয়া যায়। ত্বকীয় কোষ সুস্থ থাকলে ব্রণ, ফুসকুড়ি, দাদ সহ অন্যান্য চর্মরোগ দূরে থাকে।
৯. ক্যান্সার সৃষ্টিকারী কোষ দমন
ক্যান্সার সৃষ্টিতে দায়ী কোষগুলো ধ্বংস করতে রসুনের উপদানগুলো কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। ব্যাকটেরিয়া এবং বিভিন্ন প্রদাহের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টিকারী উপাদান রসুনে রয়েছে বিধায় তা ক্ষতিকর কোষগুলোর দমনে বেশ কার্যকর।
১০. রক্ত পরিষ্কার করে
দেহের বিষাক্ত পদার্থ দেহ থেকে বাইরে বের করে দিয়ে রক্ত পরিষ্কার রাখার কাজ করে রসুন। রক্ত বিশুদ্ধ থাকলে হৃদপিণ্ড, কিডনি সহ গুরুত্বপূর্ণ সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সুস্থ থাকে।
১১. আয়ু বৃদ্ধি
শুনে হয়তো অবাক হবেন যে, রসুন কীভাবে আয়ু বাড়াবে? তাহলে জানুন এর কারণ। রসুন এক মহৌষধি মশলা। কিডনি, ফুসফুস, যকৃত, হৃদপিণ্ড সুস্থ রাখতে রসুনের কার্যকারিতার প্রমাণ বিভিন্ন গবেষণায় পাওয়া গিয়েছে। মানবদেহের এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো সুস্থ থাকলে নীরোগ থাকা যায়, অর্থাৎ জটিল জটিল রোগ থেকে মুক্ত থাকা যায়। রোগমুক্ত জীবন হলে আয়ুও বাড়ে। কারণ, এই অঙ্গগুলোর জটিল সমস্যায় প্রতিবছর সারাবিশ্বে অনেক মানুষ মারা যায়। যদি এগুলোর রোগ প্রতিরোধ করা যায়, তাহলে মৃত্যুও ঠেকানো সম্ভব হয়। ফলে আয়ু বৃদ্ধি ঘটে।
রসুন খেলে যেসব সমস্যা হতে পারে
কোনো কিছুই অতিরিক্ত হওয়া ভালো নয়। রসুনের ক্ষেত্রেও তা-ই। যদিও রসুন খাওয়ায় তেমন কোনো সমস্যার ঘটনা দেখা যায় না।
তবে যেসব সমস্যা হতে পারে সেগুলো হলো-
১. রক্তে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি
রসুনে এলিসিন নামক যে উপাদানটি রয়েছে তা একটি বিষাক্ত উপাদান। বিষাক্ত এই উপাদানটি অতিরিক্ত মাত্রায় দেহে প্রবেশ করলে রক্তে বিষক্রিয়া দেখা দিতে পারে। রক্তে যদি বিষক্রিয়া হয় তাহকে যকৃতে অস্বাভাবিকতার সৃষ্টি হবে। তাই অতিরিক্ত রসুন খাওয়া এড়িয়ে চলতে হবে।
২. গর্ভবতী নারীদের সমস্যা হওয়া
সালফার উপাদানটি গর্ভবতী নারীদের পরিপাকক্রিয়ায় সমস্যা তৈরি করতে পারে। তখন বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য, গ্যাস্ট্রিক সহ পরিপাকতন্ত্রের সমস্যায় ভুগতে হতে পারে।
৩. বুকের দুধ পান করানো নারীদের সমস্যা
এলিসিন বিষাক্ত পদার্থ তা আমরা জেনেছি। এটা অতিমাত্রায় দেহে প্রবেশ করলে রক্তকে বিষাক্ত করে দেওয়ার পাশাপাশি বুকের দুধও বিষাক্ত করতে পারে। সেই দুধ শিশু পান করলে শিশুর অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষতি হবে।
৪. এলার্জি
কারও এলার্জি থাকলে রসুন এলার্জিকে আরও উসকে দিতে পারে । তাই এলার্জি থাকলে রসুন এড়িয়ে যান।
৫. পেটের সমস্যা
খালি পেটে রসুন খাওয়ায় বমি, বমিবমি ভাব, মাথা ঘোরানো, বুক ও পেট জ্বালাপোড়া করার মতো সমস্যা হওয়ার সম্ভাবণা থাকে।
৬. মুখে দুর্গন্ধ
সালফার থাকায় তা তীব্র ও কড়া গন্ধ সৃষ্টি করে। কাঁচা রসুন খেলে মুখে দুর্গন্ধ হয়।
কীভাবে রসুন খেলে উপকার পাওয়া যায়?
কাঁচা কিংবা তরকারি ও ভর্তায় মশলা – যেকোনো পদ্ধতিতেই রসুন খেলে যেকোনো বয়সী মানুষই উপকার পাবে।