থাইরয়েড এর লক্ষণ

নারীদের যত রকমের রোগ বেশি দেখা যায়, সেগুলোর মধ্যে থাইরয়েড এর সমস্যা একটি। এটি হরমোনজনিত একটি সমস্যা। হরমোনের অস্বাভাবিক আচরণের ফলে এই সমস্যাটি হয়ে থাকে। শারীরিক ও মানসিক গঠন ব্যাহত হওয়া সহ  নারীদের সন্তান না হওয়ার ঘটনাও দেখা যায় থাইরয়েড এর সমস্যার কারণে। তাই এই রোগের বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত। থাইরয়েড এর সমস্যা কেন হয়, থাইরয়েড এর লক্ষণ কী কী, কীভাবে এই সমস্যা নির্ণয় করা যায় এবং এ থেকে প্রতিকার পাওয়া যায় এসব তথ্য এখানে জানতে পারবেন।

থাইরয়েড কী?

আমাদের থুতনির নিচে গলার সামনের উঁচু অংশটির সাথে যুক্ত প্রজাপতি আকৃতির গ্রন্থিটি হচ্ছে থাইরয়েড। মূলত থাইরয়েড একটি গ্রন্থি যা অন্যান্য হরমোনের সাথে আমাদের দেহের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কাজে অবদান রাখে। পরিপাকতন্ত্র, স্নায়ুতন্ত্র, দেহে তাপ উৎপন্ন করা, বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোতে থাইরয়েড জড়িত। 

এর মূল কাজ পরিপাকক্রিয়ায় বেশি দেখা যায়। মেটাবলিজম সংক্রান্ত কাজে থাইরয়েড জড়িত এবং এটি সংশ্লিষ্ট কাজ করার জন্য আরও কয়েকটি হরমোনের সৃষ্টি করে। মেটাবলিজমের কার্যক্রম পরিচালনা করতে কতটুকু হরমোনের প্রয়োজন হবে তা নির্ধারণ করে থাইরয়েড। 

সেই হরমোনগুলো স্বাভাবিকভাবে কাজ করলে তবেই দেহ কোনো সমস্যা থেকে মুক্ত থাকে। কিন্তু যখন সেই হরমোনের নিঃসরণ অস্বাভাবিকভাবে হতে থাকে, তখন দেখা দেয় থাইরয়েড এর সমস্যা। তখন বুঝতে হবে থাইরয়েড ঠিকমতো কাজ করছে না। সমস্যা বোঝার জন্য থাইরয়েড এর লক্ষণ দেখে তা নির্ণয় করতে হয় ও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হয়। সঠিক ব্যবস্থা না নিলে বিপদজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।

থাইরয়েড এর সমস্যা হওয়ার কারণ

পুরুষদের চেয়ে নারীরা থাইরয়েড সমস্যার শিকার হয়ে থাকে বেশি। সুতরাং, বোঝা যাচ্ছে যে, লিঙ্গগত কারণও রয়েছে এই সমস্যার পেছনে। নারী দেহ জটিল গঠনের। পুরুষ দেহের তুলনায় নারীদেহের গঠন ভিন্ন। গঠনগত ভিন্নতার কারণে নারীরা জটিল রোগে আক্রান্ত হয় বেশি। থাইরয়েড সমস্যা হওয়া তেমনই এক রোগ।

এছাড়া, ছেলেমেয়েরা যখন বয়ঃসন্ধিকাল পার হয়ে যৌবনকালে যায়, তখন এই হরমোন নিঃসরণে অস্বাভাবিকতা দেখা দিতে পারে। মানসিক স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে, অতিরিক্ত ডিপ্রেশন, দুশ্চিন্তায় থাকলে, গর্ভকালীন সময়ে, ডায়াবেটিস থাকলে, বাতের সমস্যা, খাবারে মাত্রাতিরিক্ত আয়োডিন, স্নায়ুর দূর্বলতা – এই কারণগুলো থাইরয়েড হরমোনের নিঃসরণকে অস্বাভাবিক করে দিতে পারে।

থাইরয়েড এর লক্ষণ

থাইরয়েড এর লক্ষণ এই সমস্যার ধরণ অনুযায়ী ভিন্ন হয়ে থাকে। মূলত, থাইরয়েড সমস্যা দুই ধরণের হয়ে থাকে। 

১. হাইপোথাইরয়েডিজম: হরমোন যদি স্বাভাবিকের তুলনায় কম উৎপাদন হয়, তখন সেই অবস্থাকে বলা হয় হাইপোথাইরয়েডিজম (Hypothyroidism)।

২. হাইপারথাইরয়েডিজম: হরমোন স্বাভাবিক মাত্রার তুলনায় অতিরিক্ত পরিমাণে নিঃসরণ হলে, সেই অবস্থাকে হাইপারথাইরয়েডিজম ( Hyperthyroidism) বলে।

এই দুই প্রকারের সমস্যার লক্ষণেও ভিন্নতা বিদ্যমান। 

লক্ষণসমূহ নিম্নরূপ:-

থাইরয়েড এর লক্ষণ
থাইরয়েড এর লক্ষণ

হাইপোথাইরয়েডিজম:

 

  • উচ্চ রক্তচাপ 
  • রক্তে কোলেস্টেরলের অস্বাভাবিকতা
  • মুখে রুচি না থাকা
  • মুখমণ্ডল, বিশেষ করে চোখ-মুখ ফুলে যাওয়া 
  • ওজন বেড়ে যাওয়া 
  • শরীরে সবসময় শীত শীত অনুভূতি 
  • বয়ঃসন্ধিকাল শুরু হতে দেরি হওয়া
  • তোতলানো (জিহ্বার আকার কিছুটা বড় হলে) 
  • দেহের অস্থিসন্ধিতে ব্যথা
  • কণ্ঠস্বর মোটা হওয়া। মেয়েদের কণ্ঠস্বর পুরুষালি হওয়া
  • শুষ্ক ত্বক
  • মেয়েদের অনিয়মিত মাসিক
  • শিশুদের দাঁত দেরিতে ওঠা
  • হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিকের চেয়ে কম
  • কয়েকদিন পরপর কোষ্ঠকাঠিন্য 
  • অণুচক্রিকা দূর্বল হয়ে যাওয়ায় দেহে কাটা, ক্ষতস্থান শুকাতে দেরি
  • শারীরিক দূর্বলতা 

হাইপোথাইরয়েডিজমের কিছু লক্ষণ হাইপারথাইরয়েডিজমের ক্ষেত্রেও দেখা যায়।

হাইপারথাইরয়েডিজম:

 

  • অতিরিক্ত খিদে পাওয়া
  • মুখমণ্ডল ফোলা
  • তোতলানো 
  • শিশুদের দাঁত দ্রুত ওঠা
  • স্নায়ুচাপ 
  • নখের গঠন দূর্বল, নখ ভেঙ্গে যাওয়া
  • দাঁতের ক্ষয়
  • চুল পড়ার হার বেড়ে যাওয়া 
  • সারা দেহের ত্বকে শুষ্কতা 
  • অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে ব্যথা
  • বদমেজাজ
  • ধৈর্যশক্তি কম
  • ওজন কমে যাওয়া 
  • শরীর কাঁপা 
  • সবসময় শারীরিক দূর্বলতা লেগে থাকা
  • হৃৎস্পন্দন দ্রুত হওয়া
  • ঘুমে সমস্যা 
  • থাইরয়েড গ্রন্থিটির আকার বড় হয়ে যাওয়া, যা গলগণ্ড রোগ নামে পরিচিত 

এই দুইটির মধ্যে হাইপোথাইরয়েডিজমকে সাধারণ সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। আর হাইপারথাইরয়েডিজমকে থাইরয়েড এর সমস্যার ভয়ংকর রূপ বলা হয়। ঠিক সময়ে সতর্ক হয়ে চিকিৎসা নিলে এই সমস্যা প্রতিরোধ করা যায়।

থাইরয়েড এর লক্ষণ ও সমস্যা শনাক্তকরণ পদ্ধতি

ডাক্তাররা সাধারণত রক্ত পরীক্ষা, গলায় থাইরয়েড গ্রন্থির আকার ও সারা শরীর চেক-আপ করে হরমোনের নিঃসরণ যাচাইয়ের মাধ্যমে এই রোগটি শনাক্ত করে থাকে। কেউ চাইলে নিজে নিজেও ঘরে এটা পরীক্ষা করতে পারবে। এটা পরীক্ষা করতে শুধু প্রয়োজন পড়বে একটি আয়নার ও এক গ্লাস পানির।

নিজে নিজে যেভাবে পরীক্ষা করা যায়-

একটি স্বচ্ছ আয়নার সামনে উজ্জ্বল আলোয় দাঁড়াতে হবে। এক গ্লাস পানি নিয়ে দাঁড়াবেন। তারপর মুখ কিছুটা উপরের দিকে তুলে গলা টানটান করে দাঁড়ান। মুখে পানি নিন। গলা টান করে রাখা অবস্থায় পানি গিলতে থাকুন। পানি গেলার সময় ভালোভাবে খেয়াল করুন থাইরয়েড গ্রন্থির আকার পরিবর্তন হয় কি-না। যদি দেখেন আকার বড় হয়ে যাচ্ছে পানি গেলার সময়, তাহলে বুঝতে হবে এটি থাইরয়েড এর লক্ষণ। অর্থাৎ থাইরয়েড সমস্যা। 

যদি আরও দেখতে পান, পানি গিলতে গ্রন্থির আশেপাশে একাধিক গুঁটির মতো হচ্ছে, তাহলেও বুঝতে হবে এটি থাইরয়েড এর লক্ষণ।

তবে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার জন্য অবশ্যই ডাক্তার দেখাতে হবে।

কীভাবে থাইরয়েড এর সমস্যা প্রতিরোধ করা যায়? 

দৈনন্দিন জীবনে কিছু নিয়মকানুন মেনে চলার মাধ্যমে হরমোনের কারণে হওয়া এই রোগটি প্রতিরোধ করা সম্ভব। সেরকম কিছু নিয়মকানুন হলো-

  • প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় বিভিন্ন ধরণের শাকসবজি, ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স, ভিটামিন-ডি, আমিষ, আয়োডিন খেতে হবে।
  • মশলাদার, চিনিযুক্ত ও ভাজাপোড়া খাবার কম খেতে হবে। 
  • সুস্থ থাকতে শরীরচর্চার বিকল্প নেই। নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে। 
  • ধুমপান ত্যাগ করতে হবে। 
  • যাদের ডায়াবেটিসের সমস্যা আছে, তাদেরকে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য নিয়মিত চেক-আপ ও মেডিসিন চালু রাখতে হবে।
  • এক্সরে করানো থেকে যত সম্ভব হয় বিরত থাকতে হবে। থাইরয়েড এর সমস্যা থাকলে ডাক্তারকে তা জানান। তখন ডাক্তারই ব্যবস্থা নিবে এক্সরে করাবে কি-না।
  • থাইরয়েড এর সমস্যা শনাক্ত হওয়ার পর ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত মেডিসিন খেয়ে যেতে হবে। মেডিসিন বন্ধ করা যাবে না।
  • পর্যাপ্ত ঘুমাতে হবে।

এই বিষয়গুলো সতর্কতার সাথে মেনে চললে এই রোগটিকে প্রতিরোধ করা যাবে।

 

থাইরয়েড এর লক্ষণ
থাইরয়েড এর লক্ষণ

এর প্রতিকার সম্ভব কি?

জবাব হলো – না, পুরোপুরি প্রতিকার সম্ভব নয়। হাইপো অথবা হাইপারথাইরয়েডিজম – যেটাই হোক, কোনোটাই পুরোপুরি প্রতিকার করার মতো মেডিসিন এখনও বের হয়নি। উপরিউক্ত নিয়মকানুনসমূহ এটি প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। এগুলো মেনে চলার মাধ্যমে হাইপোথাইরয়েডিজম আক্রান্ত রোগীরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। তবে হাইপারথাইরয়েডিজমের বেলায় তা কঠিন।

হাইপারথাইরয়েডিজমে পুরোপুরিভাবে প্রতিকারের ব্যবস্থা না থাকলেও থাইরয়েড গ্রন্থির ক্ষতিগ্রস্ত অংশটুকু অপারেশন করে অপসারণ করে এই সমস্যা অনেকাংশেই দূর করা যায়।

যাদের বেশি সতর্ক থাকতে হবে 

ডায়াবেটিস আক্রান্ত ও গর্ভবতী নারীদের থাইরয়েড বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। আর যেসকল নারীরা মেনোপজ দশায় এসেছে, তাদেরও সচেতন থাকতে হবে। কারণ এই সময়ে হরমোন নিঃসরণে সমস্যা হলে তা দূর করা কঠিন হয়ে যায়।

পরিবারের কারও থাইরয়েড এর ইতিহাস থাকলে অন্যান্য সদস্যদের সতর্ক হতে হবে।

শুধু নারীদেরই যে এটা হয়, তা নয়। পুরুষদের মাঝেও হতে পারে। তাই, নারী ও পুরুষ সবারই সচেতন থাকা উচিত।

প্রতিটি মানুষের দেহে একাধিক হরমোন বিদ্যমান। তাই হরমোনের সমস্যা যে কারও মাঝে দেখা দিতে পারে। থাইরয়েড এর লক্ষণ সমূহ জানা থাকলে এই সমস্যা দ্রুত শনাক্ত করা সম্ভব হয়। দ্রুত শনাক্ত করা গেলে তা সমাধানের ব্যবস্থাও দ্রুত নেওয়া যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *